বিশেষ সাক্ষাৎকার
ড. এ কে এনামুল হক; ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির বিজনেস ও ইকোনমিকস অনুষদের ডিন এবং অর্থনীতির অধ্যাপক। এ ছাড়া দায়িত্ব পালন করছেন গবেষণা সংস্থা এশিয়ান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্টের পরিচালক হিসেবে। তিনি বিশ্বব্যাংক, আইইউসিএন, সেভ দ্য চিলড্রেন, আইএফসি, ইউএনডিপি, জিআইজেডসহ বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে কাজ করেছেন। ড. এ কে এনামুল হক স্যান্ডিতে উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে বাংলাদেশের পাশাপাশি দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে সক্ষমতা উন্নয়নে সক্রিয়ভাবে অবদান রেখেছেন। বাংলাদেশের অর্থনীতির সাম্প্রতিক গতি-প্রকৃতি নিয়ে কালবেলার সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি -
বাংলাদেশ টাইমস ৭১: নতুন বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি কেমন দেখা যাবে বলে আশা করছেন?
ড. এ কে এনামুল হক: নতুন বছর বাংলাদেশের জন্য অবশ্যই চ্যালেঞ্জিং হবে। যে কোনো একটি জাতীয় নির্বাচন এবং নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে দেশে এক ধরনের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। যদি সরকার গঠন করা দল অন্যান্য দলগুলোর সঙ্গে একটি সমঝোতার ভিত্তিতে এগোনোর চেষ্টা করে, তাহলে অর্থনীতির চিত্র একরকম হবে; আর যদি দ্বন্দ্ব থাকে তাহলে অর্থনীতি আরেকরকম হবে। সরকার কী ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, সেটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
গত বছর জুন পর্যন্ত বাংলাদেশের সামনে তেমন কোনো চ্যালেঞ্জ ছিল না। অর্থনীতি ভালোভাবেই চলছিল। কিন্তু জুনের পর থেকে চ্যালেঞ্জগুলো সামনে আসতে থাকে। অর্থনীতির এ চ্যালেঞ্জগুলো কাটিয়ে উঠতে হবে। ২০২৪ সালে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে। কারণ নির্বাচন হওয়া মানেই হচ্ছে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়া। নির্বাচনে দলগুলো অনেক টাকা খরচ করে এবং এ টাকা বাজারে প্রবেশ করে। বাজারে টাকার পরিমাণ বেড়ে গেলে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক। সুতরাং এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে সরকারকে যথাযথ নীতি গ্রহণ করতে হবে।
বাংলাদেশ টাইমস ৭১: বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য কোন বিষয়গুলো বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন?
ড. এ কে এনামুল হক: বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হারে অসামঞ্জস্যতা আরও বাড়তে পারে। সরকারের সামনে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের চাপ রয়েছে। নির্বাচনের জন্য তারা কিছুটা ছাড় দিয়েছে। কিন্তু নির্বাচনের পর তারা সেই ছাড়টি সম্ভবত আর দেবে না। ফলে সরকারের চাপ বাড়বে। ২০২৪ সালে আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা। মধ্যম আয়ের দেশে যেতে গেলে সরকারের লক্ষ্য ৯ শতাংশ জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জন। যেখানে প্রতি বছর বাংলাদেশে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ৬ থেকে ৭ শতাংশ। প্রতি বছর ৯ শতাংশ জিডিপির প্রবৃদ্ধি না হলে ২০৪০ সাল নাগাদ সরকার যেখানে যেতে চায় সে টার্গেট অর্জন করা সম্ভব হবে না। ৯ শতাংশ জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে টার্গেট রাখতে হবে ১০-১১ শতাংশ। আর এই ১০-১১ শতাংশ জিডিপির প্রবৃদ্ধি রাখার জন্য যে পরিমাণ বিনিয়োগ প্রয়োজন, সেটি নিয়ে আসা সরকারের একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ সরকার কীভাবে মোকাবিলা করবে সেটি গুরুত্বপূর্ণ। এই লক্ষ্য অর্জন করার জন্য মানুষের মধ্যে যে আস্থা তৈরি করা প্রয়োজন, সেটি তৈরি করা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আস্থা তৈরি করতে হবে।
বাংলাদেশ টাইমস ৭১: দেশে কর্মসংস্থানের সংকট রয়েছে। কর্মসংস্থান তৈরিতে করণীয় কী?
ড. এ কে এনামুল হক: বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। এদেশের একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো জোগানের দুর্বলতা। আমরা যেদিকেই যাব সেদিকেই কোনো না কোনো সংকট থাকবে বা রয়েছে। আমরা যদি রাস্তা খুঁজি সেখানেও দেখব রাস্তার সংকট রয়েছে। গাড়ি খুঁজলে দেখব গাড়ির অভাব। এ জোগানের সংকট দূর করার জন্য বাংলাদেশের বিনিয়োগ প্রয়োজন। আমরা এখনও রেমিট্যান্স নির্ভর অর্থনীতিতে রয়েছি। বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপ রয়েছে এবং দারিদ্র দূরীকরণ এখনো বড় চ্যালেঞ্জ।
বাংলাদেশের অর্থনীতির প্যারামিটারগুলোর দিকে তাকালে বোঝা যায় যে এখানে মূল্যস্ফীতি থাকবে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য ৭-৮ শতাংশ মূল্যস্ফীতি স্বাভাবিক। কারণ বাংলাদেশে চাহিদার চাপ রয়েছে। বাংলাদেশ যদি উন্নত দেশ হতো তাহলে হয়তো চাহিদার চাপ থাকত না। সেক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি ২-৩ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতো। ফলে মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জটি খুব বেশি গুরুতর মনে হয় না। মূল্যস্ফীতি কমবেশি সব সময় থাকবে। গত ২০ বছর ধরে এভাবেই চলে আসছে। সুতরাং এটা নিয়ে অনেক বেশি চিন্তিত হওয়ার কারণ নেই। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। নতুন নতুন চাকরির ক্ষেত্র তৈরি করা। চাকরির বাজারে নতুন চ্যালেঞ্জ সামনে আসছে। আগামী ১০ বছরে অনেক ধরনের চাকরির বাজার আর থাকবে না। কম্পিউটার অর্থাৎ অটোমেশন এবং এআই এর কারণে বাজার থেকে অনেক চাকরি চলে যাবে। নতুন চাকরির ক্ষেত্র তৈরি করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে।
বর্তমান প্রযুক্তির যুগে অনেক চাকরি বাজার থেকে চলে গেলেও নতুন সুযোগও সৃষ্টি হবে। অনেক ক্রিয়েটিভিটির সুযোগ রয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে ক্রিয়েটিভিটি নিয়ে আসা প্রয়োজন। শিক্ষা ক্ষেত্রে ক্রিয়েটিভিটি নিয়ে আসতে পারলে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা অনেক সহজ হবে। কিন্তু দেশের শিক্ষক এবং অভিভাবকরা নতুন ধরনের শিক্ষার সঙ্গে পরিচিত নন। তারা নতুন ধরনকে গ্রহণ করতেও প্রস্তুত নন। তারা মনে করেন তাদের সময় যেভাবে পড়াশোনা করে এসেছেন সন্তানরা সেভাবেই পড়াশোনা করবে। আমরা সবাই মনে করি পরীক্ষা ছাড়া ছাত্রদেরকে চেনার আর কোনো উপায় নেই। কিন্তু এরকম অনেকেই রয়েছেন যারা পরীক্ষায় ভালো করেননি কিন্তু জীবনে সফল। অথচ এটাকে আমরা এখনও মডেল হিসেবে দেখতে পারছি না।